১৮ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৫ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ


স্বাধীনতার ৪৭ বছর : উন্নয়নশীল দেশ হলে যেসব লাভ-ক্ষতি

স্বাধীনতার ৪৭ বছরের মাথায় স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হওয়ার প্রাথমিক স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। প্রায় ৫ দশকের বিন্দু বিন্দু প্রচেষ্টার ফল এসেছে জাতিসংঘের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতিতে। যা এ দেশের স্বপ্নযাত্রায় যুক্ত করেছে আরেকটি গৌরবময় অধ্যায়। বিশেষ করে বিশ্বের চোখে ব্র্যান্ডিং বাংলাদেশ উঠে এসেছে; যা আরও উজ্জ্বল হবে।

উন্নয়নশীল দেশ হলে অনুদান ও সহজ ঋণ প্রাপ্তি কমবে। তবে বাড়বে বড় ঋণের সক্ষমতা। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে হবে। এজন্য প্রয়োজন বহুমুখী রপ্তানি ও বাজার সক্ষমতা বৃদ্ধি। এছাড়া বিনিয়োগ আকর্ষণ ও মানবসম্পদ উন্নয়ন অপরিহার্য অর্থাৎ যেতে হবে বহুদূর।

বিশ্লেষকদের মতে, উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় উঠতে মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটির যে কোনো দুটি অর্জন করলেই চলে; কিন্তু বাংলাদেশ তিনটি সূচকেই যথাযথ মানদণ্ড অর্জন করেছে। এমন স্বীকৃতি বাংলাদেশের পথ চলাকে আরও সুগম করবে। তবে, এখানেই শেষ নয়। অর্জনের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে সামনে আরও অনেক দূর যেতে হবে। এতে থাকবে আরও অর্জন এবং নানা চ্যালেঞ্জ। উন্মুক্ত হবে নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার।

জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) অধিবেশনে গত বৃহস্পতিবার এলডিসি তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনসংক্রান্ত ঘোষণা আসে। এরই মধ্যে ঘোষণা সংক্রান্ত চিঠি জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত মাসুদ বিন মোমেনের কাছে হস্তান্তর করেছে সিডিপি। শুক্রবার বিকালে নিউইয়র্কে বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে এক অনুষ্ঠানে তার হাতে এ চিঠি তুলে দেন সিডিপির সেক্রেটারিয়েটের প্রধান রোলান্ড মোলেরাস।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক কাউন্সিলের মানদণ্ডে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১ হাজার ২৩০ ডলার। বাংলাদেশের সেখানে রয়েছে ১ হাজার ২৭১ ডলার। মানবসম্পদ সূচকে প্রয়োজন ৬৬ বা এর বেশি। বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২.৯।

এছাড়া অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচকে হতে হবে ৩২ বা এর কম। সেখানে বাংলাদেশের আছে ২৪.৮ শতাংশ। তিন সূচকেই বেশ ভালো করেছে বাংলাদেশ। তবে এখনই চূড়ান্ত হচ্ছে না উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ। এর জন্য আগামী তিনবছর অর্থাৎ ২০২১ সাল পর্যন্ত এ দেশকে পর্যবেক্ষণে রাখবে সিডিপি। উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রেখে তাতে উত্তীর্ণ হলেই ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি মিলবে বাংলাদেশের।

অর্থনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের এ স্বীকৃতি অনেক বড় অর্জন। বিশেষ করে এক সময় যারা বাংলাদেশকে কিছু নেই বলে তলাবিহীন ঝুঁড়ির আখ্যা দিয়েছিল তারাই এখন দেখছে দেশটির পথচলা। এর আগে যে ৫টি দেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের স্বীকৃতি পেয়েছে, তাদের কেউ দুটির বেশি সূচকে একসঙ্গে উন্নীত হতে পারেনি, কিন্তু বাংলাদেশই প্রথম তিনটি সূচকেই ভালো করেছে। তবে এর জন্য সামনের দিনে অনেক চড়াই-উতরাই পার হতে হবে। তাহলেই মিলবে চূড়ান্ত অর্জনের স্বীকৃতি।

তাদের মতে, উন্নয়নশীল দেশ হলে বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশে পাওয়া অগ্রাধিকার বাজার সুবিধা (জিএসপি) হারানোর মাধ্যমে রপ্তানি আয়ে বড় প্রভাব ফেলতে পারে। তাছাড়া অনুদান ও সহজ শর্তে ঋণের সুবিধা হারানোর চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একই সঙ্গে সুদের হার বাড়লেও ঋণ নেওয়ার সক্ষমতা বাড়ায় ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের মাধ্যমে অবকাঠামো খাতে দ্রুত উন্নয়নের সুযোগও রয়েছে। আবার আর্থিক সূচক ও মাথাপিছু আয়ের উন্নতির কারণে বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানির এ দেশে বিনিয়োগের পথও সুগম হবে।

মাথাপিছু আয় বাড়ায়, ক্রয়ক্ষমতাও বাড়বে, বিদেশি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো দেখবে এ দেশে এলে তাদের বাজার পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার মানবসম্পদ উন্নয়নের ফলে বিনিয়োগকারীরা জানবে এ দেশে লোক পাওয়া যাবে, হয়তোবা প্রশিক্ষণ দিতে হবে। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা কম হওয়ার কারণে তাদের বিনিয়োগে যে ঝুঁকি কম হবে তা তারা বুঝতে পারবে। তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে প্রাথমিক অর্জনের এ ধারাবাহিকতা ধরে রাখা এবং একই সঙ্গে এসব সূচকে আরও ভালো করার বিষয়টি।

এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এক্ষেত্রে ভালো দিকের মধ্যে হচ্ছে বিভিন্ন খাতে অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশ অনুন্নত দেশের মানদ- ছাড়িয়ে উন্নত দেশের মানন্ডে পৌঁছেছে তা সবাই উপলব্ধি করতে পারবে। এতে বিদেশিরা বিশেষ করে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থার জায়গা তৈরি হবে। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক বাজারে ব্রান্ডিং বাংলাদেশ আরও উজ্জ্বল হবে। সবার মনে আগে যে চিত্র ছিল এ দেশে রোগ, দুর্যোগ ও ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ, সে অবস্থার অবসান হবে।

সবাই জানবে বাংলাদেশ আর তলাবিহীন ঝুঁড়ি নয়, এ দেশ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাচ্ছে। আর চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে সূচকগুলোর উন্নতির ধারাবাহিকতা ধরে রাখা। রপ্তানি বহুমুখীকরণ, গার্মেন্টনির্ভরতা কমিয়ে অন্য পণ্যে জোর দেওয়া এবং রপ্তানি প্রবৃদ্ধিতে ছন্দ ধরে রাখতে হবে। অপর দিকে দিন দিন জমির পরিমাণ কমছে। তাই শুধু রপ্তানি বাড়ালেই হবে না, খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কৃষির উৎপাদনশীলতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি করার বিকল্প নেই।

আবার দুর্যোগ মোকাবিলার সক্ষমতা বৃদ্ধিও একটি বড়দিক। অপর দিকে এলিডিসি থেকে বের হওয়ার কারণে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও কানাডাসহ ৪০টি দেশ ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছ থেকে যেসব সুবিধা পাওয়া যেত, সে সবের পথ সংকুচিত হবে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াতে হবে। এজন্য অবকাঠামো, বিভিন্ন ব্যবসায় নীতি সহজীকরণ এবং মানবসম্পদ ও দক্ষ শ্রম শক্তির ওপর জোর দিতে হবে।

তবে মাথাপিছু আয় বাড়া ও এলডিসি থেকে বের হলে জলবায়ু তহবিলসহ কিছু অনুদান কমে যাবে, জাতিসংঘের সদস্য চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাবে। আবার কম সুদের ঋণের পরিমাণ কমে যাবে, যা আগামী দুই-এক বছরের মধ্যেই তার প্রভাব পড়বে। এক্ষেত্রে সুদের হার বেড়ে যাওয়া, ঋণ পরিশোধের সময় ও রেয়াতকাল কমে যাবে। তবে এক্ষেত্রে নতুন নতুন জানালাও খুলবে। ঋণ নেওয়ার সক্ষমতাও বাড়বে, ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা কমবে, ঋণের সীমাও বড় হবে। বড় অঙ্কের ঋণ পাওয়া যাবে। এতে অর্থায়নের জন্য উপযুক্ত ক্ষেত্র তৈরি করতে পারলে বাজার থেকে বড় বিনিয়োগ পেতে সহজ হবে।

আবার উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সুফল পেতে টেকসই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, সুশাসন ও ন্যায়বিচারের দিকেও জোর দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। এজন্য আগামী বছরগুলোতে খুবই সাবধান থাকতে হবে, যাতে আবার পিছিয়ে না আসতে হয়। এক্ষেত্রে অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ শক্তি বিকশিত করতে হবে। তবে সাবধান করে তারা এও বলছেন, এলডিসি থেকে বের হয়েছে এমন অনেক দেশের প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স কমতে দেখা গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ যখন এলডিসি থেকে বের হচ্ছে তখন বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক পরিস্থিতি অনুকূলে নয়। এজন্য উত্তরণকালীন সময়ে টেকসই অর্থনীতি ধরে রাখা ও নতুন উচ্চ সুদ মোকাবিলায় কৌশল নির্ধারণের ওপরও জোর দিয়েছেন তারা।-বিডি২৪লাইভ

ফেইসবুকে চাটখিল নিউজ ২৪ ডট কম


Shares