ডেস্ক কন্ট্রিবিউটর:
আমেরিকার একটা ইউনিভার্সিটিতে কুরআন পড়া ও তার সুক্ষ বিশ্লেষণধর্মী পাঠ বাধ্যতামুলক করা হয়েছে এবং সেটি হয়েছে মেইনস্ট্রিম মিডিয়া সহ খৃষ্টবাদী সংগঠনের প্রবল বিরোধিতাকে সফলভাবে মোকাবেলা করেই।
আমেরিকার University of North Carolina (UNC) -এ অধ্যয়নরত প্রথমবর্ষের ছাত্রদের জন্য একটি বই বাধ্যতামুলক ভাবে পাঠ্যসুচীতে (গ্রীষ্মকালীন পাঠ্যবিষয় হিসেবে) অন্তর্ভূক্ত করে ২০০২ সালে। এর প্রতিবাদে কিছু উগ্রপন্থী খৃষ্টবাদী সংগঠন বিশেষ করে, যুক্তরাষ্ট্রের ভিত্তিক, দু‘জন মার্কিন নাগরিক, যথাক্রমে; James Yocuvelli ও Terry Moffitt এবং সেই সাথে ঐ একই ইউনিভার্সিটির কয়েকজন ছাত্র মিলে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ করে। এদের সাথে অচিরেই স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বও জুটে যায়। তারা স্থানীয় রাজ্য সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে দেন দরবার চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে স্থানীয় এমপিরা ইউনিভার্সিটি কর্তৃক কুরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক এই কোর্সে অর্থায়ন বন্ধ করে দেবার পক্ষে ভোট প্রদান করে, এ সিদ্ধান্তটি ইউনিভার্সিটি পরিচালনা পরিষদকে জানিয়ে দেয়।
এর ফলে ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ তাদের কারিকুলাম ঠিক রেখেই কোর্সে কিছুটা পরিবর্তন আনে। পরিবর্তনটা হলো এই যে, কোনো ছাত্র যদি কুরআন পড়তে না চায় বা ছাত্রের অভিভাবকরা যদি তাদের সন্তানদের তা পড়তে না দিতে চায়, তবে তারা তা করতে পারবে। তবে সে ক্ষেত্রে উক্ত ছাত্রকে তার গ্রীষ্মকালীন কোর্স হিসেবে সে কেন কুরআন পড়তে চায় না, সে বিষয়ের উপরে একটা পেপার জমা দিতে হবে তার ইউনিভার্সিটি বরাবর।
কিন্তু এ সংশোধনিতে কোর্সের বিরোধিতাকারীরা সম্মত হতে পারে নি। তাদের দাবী ছিলো, ইউনিভার্সিটির এ দাবী মেনে নিলেও ছাত্রদের কোনো লাভ হবে না। কারন, কোনো ছাত্র যদি কোরানের কোর্সটি করতে না চায়, তার পরেও তাকে এই না চাওয়ার পক্ষে সাফাই গেয়ে ইউনিভার্সিটিতে পেপার জমা দিতে গেলে কোরআনের বিরোধিতা করে বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবন্ধ লিখতে হবে আর সে প্রবন্ধ লিখতে গেলে তাকে কুরআন পড়তেই হচ্ছে!
অতএব তারা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের এ স্বিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট হতে না পেরে আদালতের শরণাপন্ন হয়। তারা ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ কর্তৃক কুরআন ও তার ব্যাখা সম্বলিত বইটি পড়ানো সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একটা নিষেধাজ্ঞা জারি করার জন্য আদালতে আবেদন জানান। তবে আদালতের বিচারকরা তাদের এ আবেদনকে নাকচ করে দেন।
যে বইটি নিয়ে এত লংকা কান্ড ঘটে গেলো, সেই বইটির ব্যপারেই এখনও কিছু বলা হয় নি আপনাদের। মার্কিন Michael A Sells গবেষকই নন, তিনি তুলনামুলক ধর্মত্বত্ত বিষয়ে একজন বিদগ্ধ পন্ডিতও বটে। তিনি Haverford University এর Comparative Religion এর একজন Professor, শিক্ষক। তিনি ইসলাম, কুরআন ও মুসলমানদের জীবন রাজনীতি ও ইতিহাস নিয়ে ইতোমধ্যেই তিনি বেশ কিছু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ লিখেছেন।
অতি সম্প্রতি তিনি আল কুরআনের ৩০তম পারা তথা আমপারার ৩৫টি সুরা বাছাই করে সে সব সুরার শানে নুযুল, আলোচনার বিষয়বস্তু, নাযিল কালীন সময়ের ইতিহাস ঘটনাপ্রবাহ ও প্রাসাঙ্গিকতা ও সুরাসমুহে ব্যবহৃত ভাষা, ছন্দ, কাব্যিক আবেদনসহ এসব সুরার মূল শিক্ষার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে ‘Approaching The Quran; The Early Years’ শীর্ষক একটা বই লেখেন। বইটি সমাজের বিভিন্ন মহলে অ্যত্যন্ত ব্যপক জনপ্রিয়তার পাশাপাশি বিতর্কেরও জন্ম দেয়। তবে মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে সচেতন মহলে বইটি ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতাও পায়।
কুরআনের তাফসির সম্বলিত এই বইটিকেই University of North Carolina (UNC) তাদের ছাত্রদের জন্য গ্রীস্মকালীন কোর্সের মূল পাঠ্যসুচী হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করে। আর এতেই ইসলাম বিদ্বেষী মহলে গাত্রদাহ শুরু হয়। তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়ে এর বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে এবং ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষকে তাদের স্বিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য করতে উঠে পড়ে লাগে। লেখালেখি বক্তৃতা-বিবৃতি, নিন্দাবাদ প্রচার-প্রচারণা’সহ মামলা, সব কিছুই ঘটে একের পর এক। ঐ চিহ্নিত ইসলাম বিরোধি মহলের সাহায্যে এগিয়ে আসে বাঘা বাঘা ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াগুলোও।
বিখ্যাত এপি নিউজ মিডিয়া ২০০২ সালের ২রা আগষ্ট বিষয়টি নিয়ে নিউজ কভার করে। এর মাত্র ক‘দিন পরে এসে ৭ই আগষ্ট বিবিসি‘ও সংবাদ প্রচার করে। তারা ইউনিভার্সিটির ভিসি James Moeser এর স্বাক্ষাৎকার প্রচার করে। এক প্রশ্নের জবাবে ভার্সিটির ভিসি বলেন ‘আমরা কোনো ধর্মকে প্রচার করছি না, বরং আমরা এমন একটা বিষয় পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভূক্ত করেছি যে, এই বিষয়টির চেয়ে ‘সমকালীন’ বলে কোন বিষয় আর নেই।’
আর এর মাত্র একদিন পরে স্থানীয় রেডিও ষ্টেশনে এক উগ্রপন্থী খৃষ্টান পাদ্রী বিষয়টি নিয়ে আলোচনার এক পর্যায়ে সরাসরি আল কুরআনকেই আক্রমণ করে অশালীন ও অগ্রহণযোগ্য বক্তব্য দিয়ে বসে। তারই রেশ ধরে ‘ Franklin Graham ’ নামক অন্য এক খৃষ্টান পাদ্রী একইভাবে ইসলাম ও আল কুরআনকে সন্ত্রাসবাদের সমার্থক হিসেবে অভিহিত করে আপত্তিকর বক্তব্য দিতে থাকে। এর ফলে আমেরিকায় মুসলমানদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ‘Council on American Islamic Relations (CAIR) ’ তাদের এই সব বক্তব্যের বিরোধিতায় এগিয়ে আসে।
সুখের কথা হলো, ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ কোনরকম চাপের কাছেই নতী স্বীকার না করে তাদের স্বিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ফলে আশাতীত সংখ্যায় ছাত্রছাত্রী তাদের গৃষ্মকালীন পাঠ্যবিষয় হিসেব আল কুরআনের ক্রিটিকাল স্টাডিতে অংশ নেয়। এভাবেই খোদ আমেরিকায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আল কুরআন পাঠ্যসূচীতে ঠাঁই করে নেয়।
লেখা: সাহিত্যিক,গবেষক ও ইসলামী চিন্তাবিদ জিয়া-উল-হক